ঢাকার আশুলিয়ার রাশেদুল হাসান ওরফে শাওন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেইসাথে দীর্ঘ আড়াই বছর পর ঘটনায় জড়িত নওশাদ ওরফে চম্পা এবং তার গুরুমা দেলু হিজড়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বিকাল ৪টার দিকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলা পিবিআই এর উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আনোয়ার হোসেন।
জানা যায়, ২০২১ সালের ৭ জুন ঢাকার আশুলিয়া থানার এনায়েতপুর গ্রামের সবজিরখেত থেকে একটি অর্থগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শফিউল্লাহ শিকদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি দুই মাস থানা পুলিশ তদন্ত করার পর পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। পরে এসআই আনোয়ার হোসেন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন।
তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, ঘটনাস্থলসহ আশপাশে যোগাযোগ করি। পাশের পাঁচ তলা বাড়ির মালিক মো. আক্তার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, লাশ উদ্ধারের পরের দিন তার বাসার নিচ তলার ভাড়াটিয়া চম্পা হিজড়া তার বাবার অসুস্থতার কথা বলে জামালপুর জেলার জামতলী গ্রামে যান। ওই ঠিকানায় চম্পা নামের এক হিজড়ার গ্রামের বাড়ি আছে। তার আগের নাম ছিল নওশাদ। ২০ বছর আগে তার বাবা-মা মারা গেছেন। চম্পা ঢাকায় বসবাস করেন। মাঝে মধ্যে তিনি গ্রামে বেড়াতে যান।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পরেও লাশ উদ্ধারের পরের দিন বাবার অসুস্থতার কথা বলে গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে রাকিব হাসান শাওনের ঠিকানা পাওয়া যায়। পরে ভুক্তভোগী রাকিব হাসান শাওনের স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করে তার বাবার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। শাওনের বাবা জানান, তার ছেলে রাকিব ঢাকায় এক হিজড়ার সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু কোথায় থাকেন সেই ঠিকানা তিনি জানেন না।
রাকিবের নিবন্ধনকৃত একটা মোবাইল নম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই নম্বরটা তার ছেলে রাকিব হাসান ব্যবহার করেন। কিন্তু লাশের ছবি দেখালেও তিনি তার ছেলের লাশ সনাক্ত করতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করান। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঢাকার আশুলিয়ায় উদ্ধার হওয়া লাশ রাকিব হাসানের।
পরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৭ অক্টোবর রাত আটটার সময় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার হিজড়া পল্লীতে অভিযান চালিয়ে চম্পা হিজড়াকে গ্রেপ্তার করি। তাকে সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গ্রেপ্তার চম্পা হিজড়ার বরাত দিয়ে এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, চম্পা জন্মগতভাবে হিজড়া ছিলেন না। তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ। তার নাম ছিল নওশাদ। ১২ বছর বয়সী আকাশ নামে তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবন যাপন শুরু করেন এবং হতাশ হয়ে পড়েন। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পরে তার দেলু হিজড়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে বলেন, হিজড়া দলে যোগ দিলে তিনি অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। তার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয়। ওই ডাক্তার এর আগেও অনেক লোককে অপারেশন করে হিজড়া বানিয়েছেন। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে চার থেকে পাঁচ বছর কাজ করে। পরে সে ঢাকায় এসে আশুলিয়ার এনায়েতপুর গ্রামে বসবাস শুরু করে। আশুলিয়ায় বসবাস করার সময় ভুক্তভোগী রাকিব হাসান শাওনের সঙ্গে পরিচয় হয়। রাকিব অবিবাহিত পুরুষ। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং স্বামী-স্ত্রীর মতো একসঙ্গে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করে। ভুক্তভোগী রাকিবের সব খরচ চম্পা বহন করতো। ওই বছরের ১ জুন রাকিব চম্পার কাছে এক হাজার টাকা চায়। কিন্তু ওই টাকা না দেয়ায় রাকিব চম্পার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। রাকিব আবার চম্পার কাছে ২০ টাকা চায়। চম্পা তখন রাকিবকে ২০ টাকা দিলে রাকিব ওই টাকা নিয়ে ঘুমের ওষুধ মাইলাম কিনতে বাইরে যায়। ওষুধ কিনতে যাওয়ার সময় রাকিব ভুলে তার মোবাইল বাসায় রেখে যায়। ওই সময় রাকিবের মোবাইলে রিপা নামের আরেক হিজড়া ফোন করে। চম্পা ওই ফোনটি রিসিভ করে জানতে পারে রাকিবের সঙ্গে রিপার প্রেমের ও শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। মাইলাম ট্যাবলেট কিনে রাকিব বাসায় ফিরে আসলে চম্পার সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। তখন চম্পা রাকিবের গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে। রাকিবকে হত্যার পর চম্পা তার গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে ওই লাশ বস্তায় ভরে গুমের চেষ্টা করে। যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে তার জন্য চম্পা দিনের বেলায় কাজকর্ম শেষ করে বাসায় ফিরে এসে রাত যাপন করতো। ছয় দিনের মাথায় ৭ জুন প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় চম্পা রাকিবের লাশ বস্তায় ভরে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশের সবজি ক্ষেতে ফেলে দেয়। পরে চম্পা তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকে। ৮ জুন সকালে স্থানীয় লোকজন বস্তাবন্দি লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেয়।