আলমাস হোসেনঃ ঢাকা জেলা প্রতিনিধি
ঢাকার আশুলিয়ায় একই পরিবারের তিনজনকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মূলহোতা সাগর আলী (৩১) ও তার স্ত্রী ইশিতা বেগমকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল। সোমবার রাতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে বহুল আলোচিত ও ক্লুলেস এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা ভুয়া কবিরাজি করতে গিয়ে প্রথমে অর্থের লোভে ও পরে কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। মঙ্গলবার (০৩ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডের সময় ভুক্তভোগী মোক্তারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া আংটি। এর আগে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া ফকিরবাড়ী মোড় এলাকার শেখ মেহেদী হাসানের ছয়তলা ভবনের চার তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে স্বামী (মোক্তার), স্ত্রী ও তাদের ১২ বছরের সন্তানের অর্ধগলিত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভুক্তভোগীর ভাই আয়নাল হক বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়।
খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাগর আশুলিয়ার বারইপাড়া এলাকার একটি চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় মোক্তারকে পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ঔষধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখে। সাগর জানতে পারে মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো উপকার পায়নি। গ্রেপ্তার সাগর কৌশলে মোক্তারকে ডেকে নিয়ে আসে এবং কথাবার্তায় জানতে পারে যে, মোক্তারের ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ ও আস্থা রয়েছে। মোক্তার তার ও তার পরিবারের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কথাও সাগরকে জানায়।
র্যাবের এই কর্মকতা বলেন, গ্রেপ্তার সাগর জানায় যে, তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং সে তার সমস্যার সমাধান করে দিবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দেন। একপর্যায়ে সাগর চিকিৎসার জন্য ভুক্তভোগী মোক্তারের সঙ্গে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করে। সাগর ও তার স্ত্রী ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ঔষধসহ তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবে বলে জানায়। তারা পরিকল্পনা করে ভুক্তভোগী মোক্তারের বাসায় গিয়ে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে তার পরিবারের সবাইকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করবে। পরিকল্পনা মতে গ্রেপ্তার সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে ১ বক্স (৫০টি) ঘুমের ঔষুধ নেন।
গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানায় যে, ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে সাগরের সঙ্গে তার আত্নীয়ের মোবাইল ফোনে কথা বলে শর্ত মোতাবেক চিকিৎসার ৯০ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যাপারে মোক্তার আশ্বাস প্রদান করে। সে মতে পরদিন সকালে সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের বাসায় যান। বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয়ের পর সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শুনে এবং ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ঔষধ মিশিয়ে তাদেরকে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার ঔষধ বলে খাওয়ায়। পরে মোক্তার, তার স্ত্রী ও তার ছেলে ঘুমের ঔষধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তারের হাত ও পা বাঁধে, পরে মোক্তারের স্ত্রীর হাত-পা বাঁধে। তারা মোক্তারের মানিব্যাগ, তার স্ত্রীর পার্স ও বাসার অন্যান্য স্থানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য তল্লাশি করে মাত্র ৫ হাজার টাকা পায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোক্তারের গলায় উপর্যুপরি কোপ দিয়ে হত্যা করে। পরে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তাদের সকলের মৃত্যু নিশ্চিত করে মোক্তারের হাতে থাকা আংটিটি নিয়ে যায়। পরে উভয়ে ভিন্নপথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি (ভাড়া বাসায়) আসে এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মোক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী সাহিদা বেগম আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। মোক্তার ও তার স্ত্রী চাকরির উদ্দেশ্যে সন্তানসহ বেশকিছু দিন আগে ঠাকুরগাঁও হতে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন।
এদিকে, সাগর মাদকাসক্ত ছিল এবং সে বিভিন্ন পেশার আড়ালে চুরি ও ছিনতাই করতো বলে জানা যায়। এর আগেও সে ২০২০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের ৪ জনকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে একই কায়দায় গলাকেটে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র্যাব-১২ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে প্রায় সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ করে ২০২৩ সালের জুন মাসে জামিন পেয়ে গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় তার শ্বশুরের ভাড়া বাসায় কিছু দিন অবস্থান করে। দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকায় এবং তার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় সে রাজমিস্ত্রি, কৃষি শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার আড়ালে ঢাকা, সিলেট ও টাঙ্গাইলে অবস্থান করে এবং সুযোগ বুঝে চুরি ও ছিনতাই করতো বলে জানা যায়। গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।