মানিক দাস // কচুয়ায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর “অটোরিক্সা চালক সাব্বির হত্যা” মামলার রহস্য উদঘাটন এবং মূল পরিকল্পনাকারী’সহ আটক ৭জন কে আটক করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে প্রেস ব্রিফিং করেছেন পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম বিপিএম পিপিএম। ১৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হলরুমে এই প্রেসব্রিটিং সবারই করা হয়।
চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বিপিএম, পিপিএম এর সার্বিক দিক নির্দেশনায় কচুয়া সার্কেল এর সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ রিজওয়ান সাঈদ জিকু ও কচুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে কচুয়া থানা পুলিশের একটি চৌকস টিম চাঞ্চল্যকর “অটোরিক্সা চালক সাব্বির হত্যা” মামলার রহস্য উদঘাটনসহ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামীদের গ্রেফতারে তদন্ত ও আভিযানিক কার্যক্রম শুরু করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বিপিএম পিপিএম বলেন, কচুয়া থানাধীন ৪নং পালাখাল ইউনিয়নের ভূইয়ারা গ্রামের জাহানারা বেগমের ছেলে মোঃ সাব্বির হোসেন (১৮) প্রতিদিনের ন্যায় গত ২৪ জানুয়ারি দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিকাল অনুমান ৫ টার সময় ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা নিয়ে যাত্রী পরিবহনের জন্য মফস্বল এলাকার উদ্দেশ্যে বের হয়। অন্যান্য দিনের ন্যায় রাতের মধ্যে সাব্বির হোসেন বাড়ীতে ফিরে না আসায় পরদিন ২৫ জানুয়ারি সকালে জাহানারা বেগম কচুয়া থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী (জিডি নং-১৩০০, তারিখ-২৫/০১/২০২৪ইং) করেন। সাধারন ডায়েরীর তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই(নিঃ)মোঃ দেলোয়ার হোসেন রাজীব ভিকটিমকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজির একপর্যায়ে ওই দিন সকাল সাড়ে ১১টার সময় পালাখাল বাজার হতে নন্দনপুর গামী পাকা রাস্তার দক্ষিণ পাশে সেঙ্গুয়া গ্রামের জনৈক খলিল খন্দকারের কৃষি জমির পাশে কচুরিপানা ভর্তি সরকারী খালের পাড়ে রশি দ্বারা হাত পা বাঁধা এবং সুয়েটার দ্বারা মুখমন্ডল বাঁধা একটি মৃতদেহ পাওয়া যায় মর্মে সংবাদ পায়। পরবর্তীতে কচুয়া থানা পুলিশ ভিকটিমের পরিবারসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে মৃতদেহটি নিখোঁজ অটোরিক্সা চালক সাব্বির হোসেনের বলে সনাক্ত করে। পুলিশ হাত-পা ও মুখ বাঁধা এবং ধারালো অস্ত্রের জখম প্রাপ্ত মৃতদেহটি উদ্ধার করে সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে। এ ঘটনায় ভিকটিমের মা জাহানারা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে কচুয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। যার নং-২১, তারিখ-২৬/০১/২০২৪ইং, ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড দায়ের করেন
এইতদন্তের একপর্যায়ে কচুয়া থানার আভিযানিক দলটি তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনায় জড়িত পুরো অপরাধী চক্রকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা ২৪ ঘন্টা চাঁদপুর ও নারায়নগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান পরিচালনা করে চালক হত্যাকান্ড ও অটোরিক্সা লুন্ঠনে জড়িত মূল পরিকল্পনাকারী’সহ অপরাধী চক্রের ৭ জনকে আটক করতে এবং লুষ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ধৃত আসামীরা আন্তঃজেলা অটোরিক্সা ছিনতাই চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে অটোরিক্সা ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ২৩ জানুয়ারি নারায়নগঞ্জ জেলা হতে এই চক্রের ৮ জন সদস্য ধৃত আসামী হানজালা সহযোগে চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানাধীন পালাখাল বাজার হতে নন্দনপুর গামী পাকা রাস্তার মাঝামাঝি ব্রিজে অটোরিক্সা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে অবস্থান নেয়। কিন্তু তারা ঐদিন কোন ঘটনা সংঘটনের সুযোগ না পেয়ে মতলব দক্ষিণের একটি আবাসিক হোটেলে রাত্রীযাপন করে। পরদিন ২৪ জানুয়ারি পুনরায় একই উদ্দেশ্যে বের হয়ে একই জায়গায় অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে তারা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয় এবং ধৃত আসামী হানজালা, রাকিব ও অপর একজনসহ অটোরিক্সা ভাড়া করার জন্য পালাখাল বাজারে গিয়ে জনৈক জাহাঙ্গীর আলমের ভ্যারাইটিস স্টোর থেকে ১০ টাকার রশি কিনে নন্দনপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাজারে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমান সাব্বিরের অটোরিক্সাটি ভাড়া করে। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলের দুই পাশে রাস্তার উপর গ্রেফতারকৃত আনিছ ও রাজু পাহাড়ায় দাঁড়ায় এবং গ্রেফতারকৃত বাবলা ও কবিরের নেতৃত্বে অপর ২ সহযোগী পালাখাল বাজার হতে ভাড়া করা অটোরিক্সাটি লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে ওৎপেতে থাকে। পরিকল্পনা অনুসারে ভাড়া করা অটোরিক্সাটি সন্ধ্যা সাড়ে ৬ হতে ৭ টার মধ্যে মূল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে ধৃত আসামী বাবলা ও কবিরের নেতৃত্বে অটোরিক্সাটি থামিয়ে অন্যান্য সহযোগী আসামীগনসহ ভিকটিম সাব্বির হোসেনকে অটোরিক্সা হতে টানা হেচড়া করে রাস্তার ঢালে নিয়ে পালাখাল বাজার হতে ক্রয়কৃত রশি দ্বারা তার হাত-পা ও সুয়েটার দ্বারা মুখমন্ডল বেঁধে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে ধৃত আসামী রাকিব ভিকটিম সাব্বির হোসেনের ছিনতাইকৃত অটোরিক্সাটি চালিয়ে হানজালাসহ গৌরিপুর গিয়ে সকল আসামীগন পুনরায় একত্রিত হয় এবং অটোরিক্সাটি নিয়ে নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন ঝালকুড়িতে নিয়ে যায়। হত্যাকান্ডের ঘটনাটি জানাজানি হলে ২ দিন পর আসামীরা অটোরিক্সার ব্যাটারী, বডি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে সর্বমোট ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
১৩ ফেব্রুয়ারি অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ে ধৃত আসামী রাজু বেপারীর স্বীকারোক্তি মতে নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন ঝালকুড়িস্থ তার বসত ঘর হতে খুন হওয়া সাব্বির হোসেনের লুন্ঠিত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। উল্লিখিত ধৃত আসামীদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন মিজমিজি গ্রামস্থ ধৃত আসামী ভাঙ্গারী দোকানদার হামিদুর রহমানের ভাড়া ঘর হতে লুন্ঠিত ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সার ৩টি চাকা, ১টি ডিফারেনন্সিয়াল, ২টি ইন্ডিকেটর লাইটযুক্ত ১টি হেড লাইট সেট এবং একই পাড়ার জনৈক মোঃ জাহিদুল ইসলামের অটোরিক্সা গ্যারেজ হতে ধৃত আসামী হামিদুর রহমানের দেখানো ও উপস্থাপন মতে লুন্ঠিত ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সার ১২০০ ওয়াটের ১টি বৈদ্যুতিক মটর ও ১টি বৈদ্যুতিক কন্ট্রোল প্যানেল বক্স উদ্ধার করা হয়। ধৃত আসামী জহির প্রকাশ বাবলা (৪৫)র স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে এবং ধৃত আসামী রাকিবের সনাক্ত মতে চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানাধীন সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ১টি ৮ ইঞ্চি লম্বা প্লাষ্টিকের বাটযুক্ত ধারালো ছোরা উদ্ধার পূর্বক জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলেনঃ- চাঁদ বাবুরহাটের মোঃ জহির প্রকাশ বাবলা(৪৫), মতলব দক্ষিণ উপজেলার ঘোড়াদাড়ি (জলিল বেপারী বাড়ীর) মোঃ আনিছুর রহমান (২৫), একই বাড়ির মোঃ রাকিব (২৩),মোঃ রাজু বেপারী (২৫), ঘোড়াদাড়ী (কাশেম আলী প্রধানীয়া বাড়ী)মোঃ আমির হামজা প্রকাশ হানজালা(২৪),দিনাজপুর জেলার মতুল্লাপুর (মোল্লা পাড়া)হামিদুর রহমান (৪১) ও নরসিংদী জেলার পলাশ থানার চরসিন্দুর গ্রামের কবির হোসেন (৩৫)।
গ্রেফতারকৃত আদলতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।