ভালোবাসা, কেমন আছো; কোথায় আছো? সবাই বলে, তুমি নাকি মিশে আছো দেশ-সমাজ ও পরিবারে। ওই যে রেল লাইনে হাত ধরাধরি করে হাটা কিংবা বলদা গার্ডেনের সবুজ বৃক্ষের ভিড়ে যে মানব-মানবী শ্লীলতার সীমা লংঘন করছে, ওদের মাঝেও কি তুমি আছো?যে তরুণ-তরুণী পার্কের বেঞ্চিতে বসে খুনসুটিতে মেতেছিল অথবা স্কুল ফাঁকি দেয়া কিশোর-কিশোরীর হাত ধরাধরি করে হাঁটার মাঝেও কি তুমি ছিলে? নিজের স্বামীকে ঠকিয়ে পর পুরুষকে অবিভাক বানিয়ে ছলনা করে সম্পর্ক বজায় রাখা? নাকি ফেইসবুকে চার্স দিয়ে পুরনো প্রেমিকের ছবি দেখা। নাকি নিজের স্বামীকে চাকর বানিয়ে পর পুরুষের সাথে আনন্দে মেতে উঠা।
ভালোবাসা! তুমি কি ছিলে বদরুলের ধারালো সেই আঘাত কিংবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ফাঁস করে দেয়া সর্বনাশা বিশ্বাসে? যে ছেলেটা আবেগ মেশানো কণ্ঠে বলে, ‘জানপাখি! আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না’; এর উত্তরে যে মেয়েটি প্রেমের বাহুডোরে শীতলতা ছড়িয়ে বলে, ‘না, বাবু! কখনো ছেড়ে যাবো না’- তুমি কি থাকো সেখানেও?
যে স্বামী-প্রেমিক বোধবুদ্ধি ভুলে প্রেমিকার গোপন ভিডিও প্রকাশ করে দেয়, যে স্ত্রী-প্রেমিকা ‘ছেড়ে যাবো না’ বলে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও চলে যায়, চলে যায় স্বামী-সন্তান-প্রেমিককে খুন করে, তখন তোমার কেমন লাগে, ভালোবাসা? ভীষণ কষ্ট হয়, নাকি নষ্ট প্রেমের উচ্ছিষ্ট ভেবে চোখ ফিরিয়ে নাও এসব জঞ্জাল থেকে।
সবাই বলে, ভালোবাসা আছে। আমি বলি, ভালোবাসা নেই। প্রেমিকরা আমার দিকে তেড়ে আসে। প্রেমিকারা মুখ ভেংচায়। আমি ভয় পাই। কখনও কখনও ভয় পেয়ে পালিয়েও যাই। লুকিয়ে থাকি এখানে ওখানে। অপেক্ষা করি ভালোবাসার নির্মম দিকটা দেখার জন্য। ভুল বললাম, ভালোবাসায় কোনো নির্মমতা নেই। নির্মমতা থাকে স্বার্থের ভেতর। আমি দেখেছি, স্বার্থের ওপিঠে ‘নিষ্ঠুরতা’ লেখা আছে কিংবা স্বার্থের মধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতা। হায়! স্বার্থ আজ বিক্রি হচ্ছে ভালোবাসার মোড়কে। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটির আসল মানে হল- ‘তোমার কাছে আমার স্বার্থ আছে।’ স্বার্থ ফুরোলেই ভালোবাসার দোকান বন্ধ করে নিরুদ্দেশ হই আমরা। আসলেই কী আমরা নিরুদ্দেশ হই? কেউ কেউ হয়তো হয়। তবে স্বার্থের কারণে ভালোবাসা ঠিকই আমাদের হৃদমাজার থেকে চলে যায় ভিন্ন দেশে। তাইতো আজ আমি নিঃসংকোচে বলতে পারছি, ভালোবাসা নেই।
ভালোবাসা! তোমাকে দেখেছি উপন্যাসের পাতায়। দেবদাস ভালোবেসেছে পারুকে। পার্বতীর জন্য নিজেকে শেষ করেছে। ভালোবাসার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসা দেখেছি আমি তাজমহলের পাথরে। পাথর শক্ত, তবে শাহজাহানের ভালোবাসায় তাজমহলের প্রতিটি পাথর এখনও ভেজা। সেখানে জমে আছে শাহজাহানের বিরহের অশ্রু। ভালোবাসা দেখেছি নজরুলের ভেতর, যে প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যানের বিনিময়ে আশীর্বাদ দিয়েছে জীবনভর। আমরা ভালোবাসি, স্বার্থ ফুরোলে বলি, এবার আসি। কিন্তু সত্যি যারা ভালোবাসে, তারা কখনও চলে যায় না। ভালোবাসে সবসময়। সুসময়ে যেমন, দুঃসময়েও একই রকম।
আমি ভালোবাসা দেখেছি জুলেখার চোখে। আল্লাহর নবী তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তবুও তিনি তাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছেন। ভালোবাসা মানেই তো পাগলামো। ভালোবাসা কি বুঝে-শুনে হিসাব করে হয় কখনও? না, হিসাব করে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা হয় হঠাৎ করে। যখন তখন। কর্পোরেট দুনিয়ায় আমরা ভালোবাসাকেও হিসাবের ছকে ফেলতে চেয়েছি। বিনিময়ে স্বার্থের ঠুলি পরা কতগুলো মানুষ পেয়েছি। তাই তো খুব আফসোস করেই রুদ্র গোস্বামী লিখেছেন- কেমন আছো, কাকে বলবো?/সবাই দিব্যি ভালো থাকার ভান করে আছে।/কথা রেখো, কাকে বলবো?/সবার কাঁধে একটা করে না রাখা কথার পাহাড়।/কাকে বলবো, মনে রেখো?/সবার হৃদপিণ্ডে/টাঙান কয়েক প্রকার রঙিন মুখোশ।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমরাও ভালোবাসার চর্চা করি। করেছি। করব। ভালোবাসার এই ছড়াছড়ি আর ছাড়াছাড়ির খেলাও আমরাই খেলছি। খেলেছি। খেলব। তবে স্বার্থের জড়াজড়ি, সবশেষে খুনোখুনি কি বন্ধ হবে আগামী দিনগুলোতে? নাকি এ অমানবিকতাও চলতেই থাকবে ভালোবাসার মুখোশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও তীব্র গতিতে? স্বার্থের খোলস ভেঙে যদি খাঁটি ভালোবাসা বেরিয়ে আসে, বিশ্বাসঘাতকতার দুর্নাম ঘুচিয়ে যদি আমরা সত্যিকারের ভালোবাসতে পারি, হতে পারি ভালোবাসার সাধক- তবেই আমরা সার্থক হব। আমার বলা কথাগুলো মিথ্যা হবে। কিন্তু বন্ধু! যদি শুনি, স্বার্থের মোড়কে ভালোবাসার নামে তোমরা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছো, তবে মানতেই হবে- আমিই ঠিক। আমার কথাও সঠিক- ভালোবাসা নেই। কোথাও নেই সাধের ভালোবাসা।
ভালোবাসা, তুমি আমাদের মাঝে আছো কী নেই- এটা তর্কের ব্যাপার। তবে তুমি তো সত্য। তোমার অস্তিত্ব সত্য। কোথাও না কোথাও তুমি আছো। তোমার মতো করেই তুমি থাকো। কারও না কারও হৃদমাজারেই তোমার বাস। কিন্তু আমি জানি না, কোথায় তুমি থাকো। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। আমাদের আশীর্বাদ করো, যেন আমরা ভালোবাসতে পারি। ভালো রাখতে পারি। ভালো থেকো ভালোবাসা। আমাদেরকেও ভালো রেখো।
আরিফুল ইসলাম আরিফ
সহযোগী মহাপরিচালক
চর্যাপদ সাহিত্য একাডে।